অণু গল্প ১৪

সুদীপ্ত মাইতি

March 12, 2022
Comments: 0

ভালোবাসার যেমন অনেক নাম, আনন্দেরও সেরূপ। কোথায় কোন গিরিগুহার সংকীর্ণ পথ বেয়ে ধেয়ে আসে সে, আর ভেসে যায় ধনীর হর্ম্য প্রাসাদ থেকে দরিদ্রের পর্ণ কুঠির সমান আনন্দের ঝরনা ধারায়, সে খবর কেউ জানে না।  ঊষর জীবন হয়ে ওঠে শস্যশ্যামল, অন্ধকার দিন হয়ে ওঠে আলোময়, সুখহীন প্রাণে হঠাৎ খুশির ঝলকানি। তখন তুমি হয় ভেসে যাও সে স্রোতে তরী হয়ে , নয়তো পাড়ে দাঁড়িয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকো কুল ছাপানো ঢেউয়ের দিকে।

 

জীবন ধারনের প্রয়োজনে যে সামান্য বৃত্তিটুকু অবলম্বন করি, তাতে বিলাসিতা শব্দটি দূর গ্রহের কাল্পনিক কোনো শব্দ।তাই সত্যিকারের plain living এবং নিস্ফলা high thinking কে সঙ্গী করে দিনতিপাত চলছে।

 

বাড়িতে দ্রুতগামী একটি দু চাকার যান আবশ্যিক – একথা আমাকে অন্তত তিনশো ছাপান্ন জন মানুষ ছাপান্ন হাজারবার বলেছেন। আমারও যে plain living কে সরিয়ে দিতে মন চায়নি তা নয়, তবে ও-ই আয়তকার কালো ব্যাগটির শীর্ণ চেহারার দিকে তাকিয়ে সভয়ে সে চিন্তা ত্যাগ করতে হয়েছে। শেষে অনেক ভেবে, নিজের অর্থনৈতিক বুদ্ধির ওপর আস্থা রেখে ঠিক করলাম, একটা পুরনো সাইকেল কিনব। গোপন কথা নিজের মনেই রাখতে হয়, নইলে সাফল্যের শতকরা হার নেমে যায়। তাই কাউকেই কিছু না জানিয়ে, এক সন্ধ্যায় নিজের অক্ষমতার লজ্জা অন্ধকারে ঢেকে, বাড়ি ঢুকি একটি হাতবদলী পুরনো সাইকেল নিয়ে। দীন হীনের লজ্জা নিয়ে সে যখন আমার সাথে তার নূতন বাড়িতে প্রবেশ করল, তখন যে অভ্যর্থনা ভেসে এলো তাতে, তার চেয়েও তার নূতন মালিক আরও বেশি নুয়ে পড়ল।

 

কিন্তু, ও-ই যে বললাম – আনন্দ কখন কোথা হতে কিরূপ নিয়ে আসে তা আমরা জানি না। লজ্জার সে অন্ধকার সুতীব্র স্বরে বিদীর্ণ করে  সহসা মঞ্চে আবির্ভূত হল আমার চার বছর বয়সী পুত্র। তার হাততালিতে উড়ল শতেক পায়রা।

 

– বাবা, তুমি সাইকেল নিয়ে এসেছো? এতো বড় সাইকেল!  ও, সামনে একটা ছোট বসার জায়গা!

বাবা, এটা আমি বসব বলে তুমি লাগিয়েছো?

ঠামা, দেখো,  বাবা কি সুন্দর সাইকেল নিয়ে এসেছে।

বাবা, কাল সকালেই তুমি – আমি দুজনে বেড়াতে যাব। আমি সামনে বসব, তুমি চালাবে। কি মজা হবে। খুব আনন্দ হবে…..

 

তার উচ্ছ্বসিত কথার উৎস্রোতে ভেসে যায় পিতার সকল গ্লানি। পরিবারের লোকজনদের উপহাস, বিদ্রূপ  কিছুই তখন কানে আসছে না। গিরিগহ্বরের গোপন প্রান্ত থেকে ধেয়ে এসেছে আনন্দের  বান। ভেসে যাচ্ছে সকল হীনমন্যতার উপল খন্ড। নির্মল, শীতল ধারার মাঝে দাঁড়িয়ে কোনোরকমে জড়িয়ে ধরি চার বছরের নিষ্পাপ শিশুটিকে। বুঝতে পারিনা, পাহাড়ের বুকে এমন নোনতা জলের বান কোথা হতে এসে আমার দু’গাল  বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

Subscribe to our Newsletter